১৯৯০ বা ৯১ সালের দিকের কথা। তখন মাধ্যমিক পাশ করে কৃষিতে ডিপ্লোমা সম্পন্ন করলেই সরকারি চাকরি পাওয়া যেতো। মূলত উপজেলা পর্যায়ে পোস্টিং, পদের নাম ব্লক সুপারভাইজার। বেতন প্রাথমিকের প্রধান শিক্ষকদের থেকেও বেশি।
আমার এক আত্মীয় এই পদে চাকরি করতেন। তিনি খুব সাদাসিধে মানুষ। পোশাক-আশাকে আরও সাদাসিধে। এই দেখে একদিন তার এক সহকর্মী মন্তব্য করলেন, “আপনি এমনভাবে অফিসে আসেন, দেখে মনে হয় বিদ্যালয়ের শিক্ষক”।
তখন আমি ষষ্ঠ বা সপ্তম শ্রেণিতে পড়ি। এ ঘটনা শুনে আমার প্রচণ্ড খারাপ লেগেছিল। সোজা কথা, সহ্য করতে পারছিলাম না। আমার শিক্ষক আমার কাছে নমস্য। তাদেরকে এভাবে তাচ্ছিল্য করা? আমার খুব কাছের একজন শিক্ষকের কাছে জানতে চাইলাম, আসলেই শিক্ষকদের বেতন কম কিনা। উনি আমাকে আরও হতাশ করে বললেন, “কম মানে, অনেক কম”!
২০০৫ সালে কর্মজীবন শুরু করেছি। এবার বলছি ২০০৬ সালের কথা। বাংলাদেশের খুব নামকরা এক দাতাসংস্থার অর্থে পরিচালিত একটি শিক্ষা প্রকল্প। শিক্ষকদের বেতন ১৫০০ টাকা। শুনেই মাথা গরম হয়ে গেল। প্রকল্পের এক কর্মকর্তার সাথে আলাপ হচ্ছিলো। তিনি বললেন, “শিক্ষকদের সংখ্যা অনেক বেশি না? এক টাকা বাড়ালেও অনেক টাকা বেড়ে যায়। তাতে প্রকল্প ব্যয়ই অনেক বেড়ে যায়”।
আমার মন ভরলো না। পরে ওই প্রকল্পের দাতাসংস্থার অফিসের বড় এক কর্মকর্তার সাথে একদিন সুযোগ পেয়ে আলাপ করছিলাম বিষয়টি নিয়ে। তিনি বললেন, “আরে, ওদের জন্যে তো এটিই বেশি! ওদের তো বিশেষ কোনো যোগ্যতাই নেই। আর বাড়ির আশেপাশেই বিদ্যালয় এবং এটি তো সারাদিনের কাজ নয়। নাচতে নাচতে আসে আর একটু পড়িয়ে চলে যায়। এখানে বলে রাখি, ওই কর্মকর্তার বেতন তখনকার বাজারেই কয়েক লাখ ছিলো”।
২০০৮ সালের কথা। সিলেটের একটি এনজিওতে জরিপ করতে গিয়েছিলাম। ক্লাস দেখে আর শিক্ষকদের সাথে কথা বলে খুব একটি খুশি হতে পারলাম না। তবে তাঁরা প্রাণপণ চেষ্টা করছিলেন ভালো কিছু করার জন্যে।
আমাদের সাথে উক্ত এনজিওর একজন কর্মকর্তা ছিলেন। শিক্ষকদের মান ও পড়াশোনার ভালোমন্দ নিয়ে আলাপকালে তিনি হঠাৎ প্রশ্ন করলেন, “আপনারা যে গাড়ি নিয়ে এসেছেন, এটির প্রতিদিনের ভাড়া কতো?”
আমাদের তখনও ভাড়া গাড়ি ছিল। বললাম, ২০০০ টাকা। তিনি বললেন, আমার শিক্ষকদের বেতন মাসে ১৫০০ টাকা। মানে তাদের মাসিক বেতন আপনার একদিনের গাড়ি ভাড়ার চেয়েও কম। এদের কাছ থেকে আপনি আর কী মান আশা করতে পারেন?
শুনে আমি হতভম্ভ হয়ে গেলাম। আর কোনো কথাই বলতে পারিনি। শিক্ষকদের মুখগুলো মনে করার চেষ্টা করছিলাম। একরাশ হতাশা গ্রাস করল আমাকে।
২০০৯ বা ১০ সালের কথা। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক তাঁর একটি অভিজ্ঞতা জানাচ্ছিলেন। তাঁর বাড়ি থেকে বিদ্যালয়ে ভ্যানে করে যেতে হয়। ভাড়া সম্ভবত বারো টাকা। একদিন ভাঙতি নেই দেখে বিশ টাকার নোট দিয়েছেন। ভ্যানওয়ালার কাছেও ভাঙতি নেই। তাই বললেন, আপা, দশ টাকা থাকলে তাই দেন। আপা দেখলেন, তাঁর কাছে দুই টাকা খুচরো নেই। ভ্যানওয়ালা দশ টাকাই নিয়ে বললেন, “দেন আপা, অসুবিধে নাই! আাপনারা কয় টাকাই আর বেতন পান, দুই টাকা না হয় কমই নিলাম”।
২০১১ সালের দিকের কথা। শিক্ষক প্রশিক্ষণের কাজে একটি উপজেলা শহরে গিয়েছি। আমার সাথে অফিসের গাড়ি ছিলো। প্রশিক্ষণ শেষে ফেরার পথে শিক্ষকদের বললাম, আপনারা যারা ঢাকার দিকে যাবেন, আমার সাথে আসতে পারেন। পথে সুবিধেমতো আপনাদের নামিয়ে দেবো। তিনজনকে পাওয়া গেলো।
গাড়িতে দু’এক কথা বলার পরেই একজন জিজ্ঞেস করলেন, “স্যার, আপনাদের ড্রাইভারদের বেতন কেমন হবে?” আমি বলতে চাচ্ছিলাম না, তাই বললাম, “এই পায় আর কি, চলে যায়।” তবু তাঁরা ছাড়বেন না। আরেকজন বললেন, “তা স্যার, দশ হাজারের মতো তো পায়ই, না?” আমি এবার কী বলি? বললাম, “তা পায় বোধহয়। আমি ঠিক জানি না, স্যার।”
মিথ্যে বললাম আর মনে মনে বললাম, তাঁরা এর থেকে অনেক বেশি পান। আমার ওই আধাআধি উত্তর শুনেই তিনজনের মুখ কালো হয়ে গেলো। নিজেকে খুব অপ্রস্তুত লাগছে। একজন বলেই বসলেন, “কী করলাম বিএ, এমএ পাশ করে? সেই তো বেতন ৮৫০০ টাকা!”
২০১৩ সালের কথা। বরিশাল এলাকার ঘটনা এটি। ভদ্রলোক একটি বেসরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক। বেতন যাই হোক, টিউশনি মিলিয়ে উপার্জন একেবারে খারাপ ছিল না। ভালো শিক্ষক হিসেবে বেশ নামও করেছেন।
হঠাৎ ডিসি অফিসের পিয়নের পদে সার্কুলার হলো। তাঁর মনে হলো, তিনি পিয়নের পদে দরখাস্ত করবেন। করলেন না শুধু, রীতিমত ধরাধরি করে চাকরি জোগাড় করলেন। এখন নাকি তিনি অনেক ভালো আছেন। ক্ষমতার অনেক কাছাকাছি থাকতে পারেন। অনেক বড় বড় লোক নাকি তাঁকে এসে তোয়াজ করেন। হাতে কিছু ধরিয়েও দেন। কেন দেন, তা তো আমরা বুঝতে পারি।
২০১৭ সালের কথা। সরকার সবার বেতন বাড়িয়েছে। তাই শিক্ষকদের বেতনও বেড়েছে। এই নিয়ে মন্ত্রী থেকে শুরু করে অনেককেই খোঁটা দিতে দেখেছি। তাদের কথা, বেতন বাড়ালাম, এখন তো শিক্ষার মান ভালো হওয়ার কথা।
আমিও তেমনটিই মনে করছিলাম। তাছাড়া বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গ্রামে বাস করে সতেরো হাজারের কিছু বেশি বেতন পেয়ে ভালোই চলে যাওয়ার কথা। একদিন এই কথাই বলছিলাম প্রাথমিকের একজন সহকারী শিক্ষককে।
শুনেই তিনি একটু বিরক্ত হলেন। বললেন, “আপনিও দেখি আমাদের অফিসারদের মতো কথা বলছেন! আমি অনার্সসহ এম.এ পাশ করে এই চাকরিতে এসে পাচ্ছি ওই বেতন। আর এস.এস.সি পাশ করে, ডিপ্লোমা কমপ্লিট করেই নার্সদের বেতন আমাদের দুই ধাপ উপরে। এবার বলেন, আমরা কোথায় আছি?”
সাম্প্রতিক সময়ের কথা। জানতে পারলাম, একটি বেসরকারি শিক্ষা প্রকল্পে শিক্ষকদের বেতন দশ থেকে বারো হাজার টাকা। একই প্রকল্পের ক্লিনারের বেতন পনেরো থেকে বিশ হাজার। আর ড্রাইভারের বেতন পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশ হাজার টাকা, সাথে ওভারটাইম। আমি ভাষা হারিয়ে ফেললাম। ক্ষমতা থাকলে সব ভেঙ্গেচুড়ে ফেলতাম!
তার মানে, শিক্ষক যে কাউকে ধরে এনে বানানো যায়। আর ক্লিনার? তার উত্তরও আছে তার কাছে। এটা নাকি অনেক কষ্টের চাকরি, তাই বেতন বেশি। তার মানে, শিক্ষক হতে হলে বিশেষ কোনো যোগ্যতাও লাগে না, আর এই কাজে কষ্টও অতো বেশি হয় না।
বিষয়টি ভালো করে বোঝার জন্যে একজনের সাথে কথা বলছিলাম। তিনি বললেন, “দেখেন, ড্রাইভারের বেতন তো বেশি হবেই। এর কম দিলে তো পাওয়া যাবে না। আপনি তো আর যাকে-তাকে ধরে এনে ড্রাইভার বানাতে পারবেন না!”
তার মানে, শিক্ষক যে কাউকে ধরে এনে বানানো যায়। আর ক্লিনার? তার উত্তরও আছে তার কাছে। এটা নাকি অনেক কষ্টের চাকরি, তাই বেতন বেশি। তার মানে, শিক্ষক হতে হলে বিশেষ কোনো যোগ্যতাও লাগে না, আর এই কাজে কষ্টও অতো বেশি হয় না।
অনেককেই বলতে শুনি, যিনি আর কোনো চাকরি পান না, তিনিই কেবল শিক্ষকতা পেশায় আসেন। তাই তাঁরা সবচেয়ে কম যোগ্য আর তাঁদের বেতনও সবার চেয়ে কম হওয়াই যুক্তিযুক্ত। “আমি শুনে হাসি, আঁখি জলে ভাসি!”
কাজের সুবাদে প্রাথমিকের শত শত সুযোগ্য শিক্ষক পেয়েছি। এদেরই একজনকে বলছিলাম, “সুযোগ পেলে শিক্ষক প্রশিক্ষক হিসেবে আসতে চান আপনার চাকরি ছেড়ে? আপনার বর্তমান বেতনের কমপক্ষে তিনগুণ বেশি বেতন হবে।”
তিনি বললেন, “স্যার, কিছু মনে করবেন না। লাখ টাকা বেতন হলেও যাওয়া সম্ভব নয়।” আমার একটু আত্মসম্মানেই লাগল শুনে। পরে জানলাম, পারিবারিক কিছু দায়িত্বের কারণে উনি দূরে কোথাও চাকরি করতেই চাননি।
আরেকজন শিক্ষকের কথা বলি। তিনি উত্তরবঙ্গের একটি বেসরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক। চাকরি করতে করতেই সোনালি ব্যাংকের অফিসার পদে চাকরি পেয়ে গেলেন।
খুব জনপ্রিয় শিক্ষক। তাই খবর পাওয়ার সাথে সাথে ছাত্রছাত্রীরা তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলো। সবাই কান্না করে আর বলে, “স্যার, আপনি চলে গেলে আমাদের কে পড়াবে?” সেই মহান শিক্ষক শিক্ষার্থীদের কথা ফেলতে পারলেন না। ব্যাংকের লোভনীয় চাকরিতে যোগ না দিয়ে সেই শিক্ষক বেসরকারি বিদ্যালয়েই রয়ে গেলেন।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হওয়া একটি মেয়ে। একটু আগেভাগে বিয়ে হয়ে যাওয়ায় এলাকা ছেড়ে দূরে চাকরি করা সম্ভব ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিটা হয়নি। বিকল্প হিসেবে তিনি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের চাকরি পেয়েছেন। এরকম হাজার হাজার উদাহরণ আছে আমাদের। মুশকিল হলো আমরা দেখতে চাই কিনা।
“শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড” বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলে ফেলছি আমরা। সেই মেরুদণ্ড যে ভেঙ্গে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে, সেদিকে কারও নজর নেই। আমরা মধ্য আয়ের দেশ হতে চলেছি। খুবই আশার কথা। আমার চাকরি থাক বা না থাক, বৈদেশিক সাহায্য না নিয়ে যদি আমরা চলতে পারি; তার থেকে গৌরবের আর কিছু নেই। আমাদের অর্থনীতি প্রায় পৌঁছে গেছে সেই স্তরে।
আমার হাতে যদি ক্ষমতা থাকতো, তাহলে নিত্যনতুন চিন্তা বেশি না করে সারাদেশে আমার শিক্ষকেরা যে ভালো কাজগুলো করছেন, সেগুলো জাতির সামনে তুলে ধরতাম। আর এমন ব্যবস্থা করতাম, যাতে এই ভালো কাজগুলো সবার মধ্যে ছড়িয়ে যায়।
কিন্তু শিক্ষা? খুব আশাবাদী হওয়ার চেষ্টা-অপচেষ্টা সব করেও বলতে গিয়ে আটকে যেতে হচ্ছে। আর মুখ ফসকে বেরিয়ে যাচ্ছে, “আমাদের শিক্ষা আজ গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত!” কারণ বলতে গেলে বলা যাবে এক হাজার একটি, বা তারও বেশি। উপরের যে বাস্তব ঘটনাগুলোর উল্লেখ করলাম, তার কোনোটিই এখনও অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়নি।
আমার হাতে যদি ক্ষমতা থাকতো, তাহলে নিত্যনতুন চিন্তা বেশি না করে সারাদেশে আমার শিক্ষকেরা যে ভালো কাজগুলো করছেন, সেগুলো জাতির সামনে তুলে ধরতাম। আর এমন ব্যবস্থা করতাম, যাতে এই ভালো কাজগুলো সবার মধ্যে ছড়িয়ে যায়। কী কী ঠিক মতো হচ্ছে না, সেটি বেছে বের করতে গেলে হয়তো কম্বলসহ উজাড় হয়ে যেতে পারে। তাই চমক দেখানোর জন্যেও সে ভুল আমি করতাম না।