পৃথিবীর সবচেয়ে চমৎকার শিক্ষাব্যবস্থা দেশগুলোতে আছে তার মধ্যে অন্যতম হল ফিনল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থা। কিন্তু কেন ফিনল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থা এত ভাল এবং সেরা? চলুন জেনে নেই ফিনল্যান্ডের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার কিছু চমৎকার দিক।
বিনা খরচে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ-
ফিনল্যান্ডে শিক্ষাব্যবস্থায় সমস্ত সুযোগ-সুবিধা বিনামূল্যে প্রদান করা হয়। মধ্যাহ্নভোজ, টিফিন, বই-খাতা-স্টেশনারি, শিক্ষাসফর এমনকি স্কুলে যাতায়াত খরচ, সমস্ত কিছুই বিনামূল্যে শিক্ষার্থীরা পেয়ে থাকেন। শিক্ষা সংক্রান্ত সার্বিক খরচ সরকার বা রাষ্ট্র বহন করে থাকে এবং বার্ষিক বাজেটের ১২.২% এর বেশি শিক্ষাখাতের জন্য বরাদ্দ থাকে।
প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য স্বতন্ত্র পরিকল্পনা ও পদ্ধতি-
শুনে অবাক হচ্ছেন? হওয়ারই কথা। তবে আশ্চর্যজনক হলেও এটাই সত্যি। ফিন্ল্যাণ্ডে ভিন্ন শারীরিক ও মানসিক সামর্থ্যের শিক্ষার্থীরা একই ক্লাসে পড়ালেখা করে। কোনো শিক্ষার্থী যদি নির্দিষ্ট কোনো কাজ করতে না পারে তবে শিক্ষক তার জন্য স্বতন্ত্র পরিকল্পনা করে থাকেন এবং তার জন্য আলাদা টাস্ক ডিজাইন করা হয়। শিশুরা তাদের পছন্দমতো ও সামর্থ্যর উপর ভিত্তি করে ক্লাস টাস্ক নির্বাচন করার সুযোগ পায়। যদি লেসন ইন্টারেস্টিং মনে না হয় তাহলে শিক্ষার্থী পছন্দমতো বই পড়তে বা দোলনায় দুলতে পারে নির্দ্বিধায়।
প্রথাগত নম্বর পদ্ধতি বর্জন-
ফিনল্যান্ডের গ্রেডিং সিস্টেম ১০ পয়েন্টের উপর ভিত্তি করে দেওয়া হয় এবং থার্ড গ্রেডের আগে স্কুলে কোন নম্বর বা মার্কস দেওয়া হয়না। থার্ড গ্রেড থেকে সেভেনথ গ্রেড পর্যন্ত শুধুমাত্র মৌখিক প্রশংসাসূচক বাক্য বা ফিডব্যাক মার্কস হিসেবে দেওয়া হয় যেমন- আরও ভাল হতে পারে বা পারফেক্ট, এবং এর সবচেয়ে ভালো দিক হলো – এই মার্কস শুধুমাত্র শিক্ষার্থী নিজেই জানে। এখানকার শিক্ষকরা বিশ্বাস করেন শিক্ষার্থীদের নম্বরের চেয়ে বেশি প্রয়োজন মোটিভেশন এবং তাদের নিজস্ব স্টাডি প্ল্যানে সংশোধনের জন্য নিজের জ্ঞান ও দক্ষতা বৃদ্ধি করা। তারা তাই এই দু’টি দিকেই বেশি মনোযোগ দেন।
কোন নির্দিষ্ট স্কুল ইউনিফর্ম নেই-
ফিনল্যান্ডে কোন নির্দিষ্ট স্কুল ইউনিফর্ম নেই। শিশুরা তাদের পছন্দমতো ও আরামদায়ক পোশাক পরে স্কুলে আসতে পারে স্কুলে।
পড়ানোর সময় শোয়া ও সোফাতে বসার অনুমতি-
আমাদের স্কুলগুলোতে চেয়ার ও বেঞ্চে বসা বাধ্যতামূলক কিন্তু ফিনল্যান্ডে স্কুলগুলোতে এমন বাধ্যবাধকতা নেই। ক্লাসের মাঝে তারা চাইলে সোফায় বসতে কিংবা মেঝের কার্পেটে শুয়ে শুয়েও ক্লাস করতে পারে। খুব মজার ব্যাপার, তাইনা?
মজার বাড়ির কাজ-
ফিনল্যান্ডে শিক্ষকেরা মনে করেন যে শিশুদের বাসায় বিশ্রাম নেওয়া ও পরিবারের সাথে বেশি সময় কাটানো উচিত তাই তাদের হোমওয়ার্ক বা বাড়ির কাজ খুব একটা দেওয়া হয়না। আর দিলেও তা খুব মজার হয় এবং খুব স্বল্প সময়ে করা যায়। যেমন- ইতিহাস ক্লাসের বাড়ির কাজের একটি নমুনা হলো “শিক্ষার্থীরা তাদের দাদী বা নানির সাথে গল্প করে তার সময় এবং বর্তমান সময়ের জীবনযাপনরীতির পার্থক্য খুঁজে বের করবে”।
কোন পরীক্ষা নেই-
ফিনল্যান্ডে শিক্ষকেরা বলে থাকেন যে মানুষের হয় তার জীবনের জন্য অথবা পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া উচিত, আমরা প্রথমটি বেছে নিয়েছি। তাই আমাদের ফিনল্যান্ডের স্কুলগুলোতে কোন পরীক্ষা নেই, শুধু একটি আবশ্যকীয় পরীক্ষা আছে যখন শিক্ষার্থীরা মাধ্যমিক শিক্ষাস্তর সম্পন্ন করেন। তবে শিক্ষক বিশেষ প্রয়োজনে তার ক্লাসে ছোট খাটো টেস্ট নিতে পারেণ।
নির্দিষ্ট সাবজেক্ট বা বিষয় নেই–
ফিনল্যান্ডের কিছু কিছু স্কুলে কোন নির্দিষ্ট সাবজেক্ট বা বিষয় পড়ানো হয় না বরং একটি টপিক বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করার দক্ষতা তৈরি করা হয় শিক্ষার্থীদের মাঝে। ফিনল্যান্ডের শিক্ষা ব্যবস্থার একটি সাম্প্রতিক সংযুক্তি হল- ‘ফেনোমেনন বেজড লার্নিং’ যেখানে অনেকগুলো অধ্যায়ের পরিবর্তে একটি টপিক ৬ সপ্তাহ ধরে ছাত্র-ছাত্রীরা ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে পড়ে। যেমন- অভিবাসী বা মাইগ্রেন্ট, এই টপিকটা শিক্ষার্থীরা ভূগোল (কোথায় থেকে তারা এসেছে), ইতিহাস (এর আগে কী ঘটেছিল), সংস্কৃতি ( তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য, জীবনযাপন) ইত্যাদি ভিন্ন আঙ্গিক থেকে শিক্ষার্থীরা জানতে পারে। এজন্য ছাত্র-ছাত্রীরা নিজেরাই তাদের জন্য প্রশ্ন তৈরি করতে পারে এবং সেই প্রশ্নের উত্তরও নিজেরাই খুঁজে বের করে।
সবচেয়ে বেশি বিরতি পায় শিক্ষার্থীরা-
সারা বিশ্বে সমস্ত স্কুলগুলোর মধ্যে ফিনল্যান্ডের শিক্ষার্থীরা স্কুলে সবচেয়ে বেশি বিরতি পেয়ে থাকে। ক্লাস যতই মজার হোক না কেন, প্রতি ৪৫ মিনিট পড়ালেখা বা ক্লাসের পর শিক্ষার্থীরা ১৫ মিনিট করে বিরতি পায়।
দক্ষ ও নিবেদিত শিক্ষক-
ফিনল্যান্ডে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া খুবই প্রতিযোগিতামূলক এবং কঠিন, যার মাধ্যমে সেরা আবেদনকারীদের বেছে নেওয়া হয়। আবেদনকারীদের প্রায় প্রতি ১০ জনে একজন শিক্ষক হতে পারে এবং তাদের বেতন শুরু হয় ৩৫০০ পাউন্ড থেকে। ফিনল্যান্ডে শিক্ষকতা পেশাটি খুবই সম্মানজনক এবং সবথেকে আকর্ষনীয়। দক্ষ ও আগ্রহী শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের পড়ানোর ক্ষেত্রে তাদের সর্বোচ্চ মেধা ও পরিশ্রমের সমন্বয় ঘটাতে পারেন , আর শিক্ষক যখন সেরা তখন তার প্রতিফলন তো শিক্ষাব্যবস্থায় ঘটবেই ।
জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোই ছাত্র-ছাত্রীদের শেখানো হয়-
সাঁতার ক্লাসে শিক্ষার্থীরা শেখে কোন কোন সংকেত দিয়ে বোঝায় যে একজন মানুষ ডুবে যাচ্ছে। গার্হস্থ্য বা গৃহস্থালি ক্লাসে শেখে রান্না, সেলাই, বোনা ইত্যাদি। স্কুলে পরিবেশ এর যত্ন বা পরিবেশ সচেতনতার উপর খুবই গুরুত্ব দেওয়া হয়। ফিনল্যান্ডে স্কুল শিক্ষার্থীরা খুব সহজেই একটি ওয়েবসাইট বা পোর্টফলিও তৈরি করতে পারে। মূল বিষয় হল কোন কিছু শেখার সামর্থ্য এবং সময়ের সাথে পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য যে দক্ষতাগুলো শেখা দরকার তাই ফিনল্যান্ডের স্কুলগুলোতে শেখানো হয় কারণ যখন ইন্টারনেট আছে তখন কোন বিষয় বা সাবজেক্ট নলেজ এত গভীরে স্কুলে শেখানোর প্রয়োজন নেই।
প্রত্যেকটা স্কুলই মানসম্পন্ন-
ফিনল্যান্ডে প্রতিটা স্কুলেই দক্ষ শিক্ষক, প্রয়োজনীয় উপকরণ ও মানসম্মত খাবার রয়েছে তাই কোনো নির্দিষ্ট বা ‘এলিট’ স্কুলে ভর্তি হওয়ার প্রয়োজন নেই, শিক্ষার্থীরা তাদের নিকটস্থ এলাকার স্কুলে ভর্তি হয় এবং সমস্ত সুযোগ সুবিধা সমানভাবে লাভ করে।
শিক্ষার্থীরা নিজেদের পছন্দসই দুপুরের খাবার গ্রহণ করে–
ফিনল্যান্ডের স্কুলগুলোতে খাবার বিনামূল্যে প্রদান করা হয়। স্কুলগুলো তাদের ওয়েবসাইটে একমাস আগে থেকেই শিক্ষার্থীদের ওয়েবসাইট ভিজিট করে তাদের প্রিয় মেন্যুগুলো যুক্ত করার সুযোগ করে দেয়। পরবর্তীতে লাঞ্চের সময় স্কুল সেই খাবারগুলো খাদ্যতালিকায় রাখা হয়।
সারা রাত পার্টি–
মাঝে মাঝে ছাত্র-ছাত্রীরা তাদের স্লিপিং ব্যাগ নিয়ে স্কুলে যায় এবং শিক্ষকদের সাথে সারারাত স্কুলে থেকে মুভি দেখে, খেলা ধুলা করে এবং ঘুমায়। অতঃপর সকালে ব্রেকফাস্ট করে ও আইসক্রিম খায়।
রিডিং ডগস–
ফিনল্যান্ডের স্কুলগুলোতে বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কুকুর থাকে যার ফলে ছাত্র-ছাত্রীরা বই পড়তে আরো উৎসাহী হয়। ছাত্র-ছাত্রীরা এই কুকুরগুলোকে বই পড়ে শোনায় এমনকি কুকুরগুলোও ছাত্র-ছাত্রীদের গল্প শোনায়।
এমন স্কুলের গল্প শুনলে নিশ্চয়ই আপনারও ইচ্ছে হয় এরকম স্কুলে সন্তানকে পড়াতে কিংবা নিজের ছোটবেলায় ফিরে গিয়ে এমন কোনো স্কুলে মজায় মজায় শিখতে?