আমি মাঝে মাঝেই অফিস থেকে বের হয়ে যাই এবং কোন না কোন স্কুলের সামনে যেয়ে দাঁড়াই ঠিক স্কুল ছুটির আগে আগে, যেখানে মায়েরা সাধারণত জটলা করে থাকেন। আমার উদ্দেশ্য মায়েরা একে অপরের সাথে কী ধরনের আলাপচারিতা করেন এবং স্কুলের শিক্ষক ও নিজেদের বাচ্চাদের নিয়ে কী ভাবেন সেসব ব্যাপারে কিছুটা জ্ঞানার্জন করা। প্রতিবারই বেশ কিছু নতুন ধরণের অভিজ্ঞতা হয়। কিন্তু কিছু আলোচনা এমনও থাকে, যেগুলো আবার বেশ কমন। লেখার পরবর্আতী অংশটি পড়লে আমার মনে হয় অনেক মা-বাবাই মিল পাবেন।
মায়েদের প্রাত্যহিক আলাপচারিতার কিছু অংশ এখানে তুলে ধরছি।
# আর বলবেন না ভাবী, টিচাররা ক্লাসে যে কী পড়ায় আমার ছেলে কিছুই বুঝে না। ক্লাসে কী পড়ায় সেটাও বাসায় গিয়ে বলতে পারে না।
# টিচাররা ক্লাসে কিছুই পড়ায় না, শুধু গাদা গাদা বাড়ির কাজ দেয়।
# টিচাররা ক্লাসে কী পড়ান কিছুই জানি না। সব ক্লাসওয়ার্ক স্কুলে রেখে দেয়। বাচ্চাদের কোন হোমওয়ার্কও দেয় না যে প্রতিদিন বাসায় প্র্যাকটিস করাবো। (এটা সাধারণত প্রি-স্কুলের বাচ্চাদের জন্য বেশি খাটে)
# আমার বাচ্চাতো সবসময় excellent আর A+ পায়, আপনার বাচ্চা পায় না কেন? আমার বাচ্চাতো বলে আপনার বাচ্চা টিচারের কথা শুনে না।
# টিচার শুধু বৃহস্পতিবার সব ক্লাসওয়ার্ক দেয় আবার সাথে অনেকগুলো হোমওয়ার্কও দেয়। সপ্তাহ শেষে একেবারে ক্লাসও্যার্কগুলোও দেখতে হয় হোমওয়ার্কও করাতে হয়। একসাথে কতো ্কী করবো? দুইটা দিন মাত্র বন্ধ, বাচ্চাদের নিয়ে যে একটু বেড়াতে যাব তাও সম্ভব না।
# আমার বাচ্চাকে টিচার সবসময় পিছনে বসায়। বাচ্চা ভালো করে টিচারের কথা শুনতে পায় না আর বোর্ডও ঠিকভাবে দেখতে পায় না, তাই ক্লাসওয়ার্ক শেষ করতে পারে না।
আপনারা যারা অভিভাবক তারা নিশ্চয়ই এরকম আরও অনেক অনেক মন্তব্য বাতাসে ভাসতে দেখেছেন। এদিকে মায়েদের এতসব অভিযোগ পড়ে টিচাররা খুব চিন্তায় পড়ে গেলেন কি? মন খারাপ হয়ে গেল? ভাবছেন সারাদিন খেটে-খুটে ক্লাস নেই আর তার বিনিময়ে এই প্রতিদান! এই সব মন্তব্য!
চিন্তার কোন কারণ নেই। আপনি পড়াবেন আপনার ও আপনার স্কুলের নিজস্ব নিয়মে, এতে দোষের কিছু নেই। তবে অভিভাবকদের এইসব মন্তব্য একেবারে এড়িয়ে যাওয়াও যাবে না। তাহলে কী করতে হবে? মনে রাখবেন, অভিভাবকরা তাদের শিশুদের লেখাপড়া ও ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত বলেই এ ধরণের মন্তব্য ছুড়েন এবং বিষয়গুলো নিয়ে অন্য অভিভাবকদের সাথে আলোচনা করেন।
এইসব আলোচনা ও মন্তব্য এড়াতে হলে আপনাকে মাঝেমাঝে আলাদা আলাদা করে প্যারেন্ট মিটিং করতে হবে। যখন প্যারেন্ট মিটিং করবেন তখন শুধু তাদের শিশুরা ক্লাসে কি করলো, কি পারলো, কি পারলো না তা নিয়ে আলোচনা না করে অভিভাবকদের কাছেও জানতে চান তারা ক্লাসের লেখাপড়ার সিস্টেমে কতোটুকু সন্তুষ্ট। আরও কী করলে ভালো হয়, কী করলে তার শিশুর লেখাপড়া আরও ভালো হবে – এসব ব্যাপারে তাদের কাছেও পরামর্শ গ্রহণ করুন। তারা আপনার চেয়ে আরও ভালো জানেন তার সন্তানটি কেমন, কিসে তার আগ্রহ, কেমন তার আচরণ, বাসায় সে কি করে, তার ভালো লাগা – খারাপ লাগা ইত্যাদি। আর এগুলো থেকেই কিন্তু আপনি জানতে পারবেন আপনার ক্লাসের কোন শিশুটি আদতে কেমন। হয়তো ক্লাসের সবচেয়ে দুষ্টু শিশুটি বাসায় খুব শান্ত। আবার যাকে ভাবছেন সবচেয়ে খারাপ ছাত্র, সে হয়তো চমৎকার অভিনয় করতে পারে। একজন শিক্ষক হিসাবে আপনি আপনার ছাত্রছাত্রীকে যতটা ভালভাবে জানবেন আপনার জন্য ততটাই সহজ হয়ে যাবে তাকে পড়ানো। আমরা সবাই তো জানি যে প্রতিটি শিশুই আলাদা এবং প্রত্যেকের শেখার স্টাইল আলাদা।
অভিভাবকরা যেহেতু শিশুদের বাড়িতে পড়ায় সেহেতু তারাও কিন্তু শিক্ষক। শিশুদের পড়াতে গেলে তারাও সন্তানকে পড়ানোর কার্যকর নানা টেকনিক আবিষ্কার করে ফেলে। তারা কিছু কিছু টেকনিক প্রতিনিয়ত ব্যবহারও করেন। এভাবে তারা বুঝতে পারে কোন মেথডে পড়ালে তাদের শিশু ভালোভাবে শিখবে। অভিভাবকদের এই পরামর্শগুলো উড়িয়ে না দিয়ে সম্ভাব্য কিছু পরামর্শ ক্লাসে অ্যাপ্লাই করুন। এতে করে অভিভাবকদেরও স্কুলের ও ক্লাসের সিস্টেমের প্রতি আস্থা জন্মাবে।
মনে রাখবেন শিক্ষকতা কেবল একটি পেশা নয়, শিক্ষক হওয়ার পাশাপাশি আপনি একই সাথে ৫০-১০০ জন শিশুর অভিভাবকও। একটি শিশুর শিক্ষা সুষ্ঠু ও সুসম্পন্ন হবে যখন একটি শিশু স্কুলে যা শিখবে তার প্রতিফলন বাড়িতেও ঘটাবে। আপনি তখনই কেবল নিশ্চিত হতে পারবেন যে আপনার ছাত্রছাত্রীরা শুধু সুশিক্ষিত না স্বশিক্ষিতও হচ্ছে।
শিক্ষকদের জন্য তো অনেক কিছু বললাম। শেষ করার আগে অভিভাবকদের জন্য কিছু কথা বলি। আপনি আপনার সন্তানকে যে স্কুলে দিয়েছেন সেখানে নিশ্চয়ই অনেক চিন্তা-ভাবনা করে দিয়েছেন। আপনি জানেন স্কুলটি কেমন, তাদের নিয়ম কেমন, তারা কী বাড়িরকাজ দেয় কি দেয় না, ক্লাসে পড়ানোর কী সিস্টেম তারা ফলো করছে ইত্যাদি। না জেনে থাকলে এসব জেনে নিয়ে পছন্দ হলে তাহলেই ঐ স্কুলে সন্তানকে ভর্তি করা উচিত। শিক্ষকগণ কিন্তু সবসময়ই চেষ্টা করছেন কিন্তু আপনার শিশুকে ভালো কিছু দেয়ার। অনেক সময় শিক্ষক চাইলেও স্কুলের অনেক নিয়ম আর বাধার কারণে অনেক কিছু করতে পারেন না। তাই শিক্ষককে যেকোনো বিষয়ের জন্য দায়ী না করে আগে তার সাথে কথা বলুন। আপনি এবং শিক্ষক দুজনেই কিন্তু আপনার সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্যই কাজ করছেন। শিক্ষকের উপর আপনার বিশ্বাস রাখুন। উনি আপনার সন্তানের পড়াশুনার দায়িত্ব নিয়েছেন। উনার দায়িত্ব উনার মত পালন করতে দিন। আপনি আপনার সন্তানের ব্যাপারে কিছু পরামর্শ তাকে দিতে পারেন। এতে করে দু’জন দু’জনের চাহিদা বুঝতে পারবেন এবং সে অনুযায়ী আপনার সন্তানকে একজন সুন্দর মানুষ হিসাবে গড়ে তুলতে অবদান রাখতে পারবেন।
It’s an opinion piece by Ms. Rokiba Ahmed, Director – Education, Light of Hope. She is also a Master Trainer providing professional develop opportunities to teachers in Bangladesh.
শিক্ষক ও অভিভাবকদের জন্য Teachers Time থেকে আমরা শুরু করেছি বিভিন্ন টপিক এর উপর ভিন্নধর্মী কিছু Course, যেগুলো করার মাধ্যমে উপকৃত হবেন শিক্ষক ও অভিভাবক উভয়েই ।