Sudeb Kumar Biswas

আমরা এই ছোট্ট জীবনে কতজনের কাছ থেকে কতভাবে শিখি। জীবন থেকে শেখা আমাদের অন্যতম পাথেয়। কেউ কেউ সচেতনভাবে শেখান। একেবারে হাতে ধরে শেখান। কেউ আবার নিজের নিয়মে কাজ করে যান, আর আমরা তা থেকে যা শেখার শিখে নিই। যে নিংড়ে নিতে পারে সে ধন্য; যে পারে না, তাকে একটু পেছনেই পড়ে থাকতে হয়। একটি গ্রাম বা লোকালয় কারও কাছে হয়ে যেতে পারে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়। সে জীবনকে জীবনের পথে চলতে দেখে সেখান থেকে শেখে। শেখে মানুষের টিকে থাকার লড়াই করতে দেখে। জ্ঞানের যে উৎসভূমি—সেই মানব জীবন আর মানব সমাজ হয়ে ওঠে জ্ঞান আহরণের শ্রেষ্ঠ ক্ষেত্র। আমরা একেকজনের কাছ থেকে স্বতন্ত্র কোনো বিষয় শেখার সুযোগ পাই। কে জানে, আমাকে-আপনাকে দেখেও অনেকে অনেককিছু শিখছে। যারা শেখান, তাদের কেউ কেউ গুরুর আসনে বসে যান।

এই শেখার সূত্র ধরে একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি। আমার পেশাগত জীবনের শুরুর দিকেই পেয়েছিলাম Pedagogy of Text (PoT)-এর জনক ড. অ্যান্টোনিও ফন্দেজকে, যিনি বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ পাওলো ফ্রেইরের সাথে কাজ করেছেন। বলছি ২০০৬ সালের কথা, যখন সবে শিক্ষা নিয়ে কাজ শুরু করেছি। আমার শিক্ষাভাবনা আর কাজের বুনিয়াদ তাঁর হাতেই। তাঁর একেকটি কথার ওজন ধারণ করার মতো উপযুক্ত পাত্র হিসেবে তখন কোনোভাবেই তৈরি ছিলাম না। শিক্ষা কী, শিশুরা কীভাবে শেখে, কেন শিখবে, শিক্ষকের কী করণীয়, কীভাবে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা যায়—এসবের পাঠ নিয়েছিলাম তাঁর কাছ থেকেই। পাত্র প্রস্তুত না থাকায় খুব বেশি ধারণ করতে পারিনি। যেটুকু পেরেছিলাম, তাই ভাঙিয়ে চলছি এতোদিন।

তিনি শিখিয়েছিলেন, বর্তমান বিশ্বে এতো বৈষম্যের অনেক কারণের মধ্যে একটি কারণ হচ্ছে প্রথাগত শিক্ষার সাথে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সম্পর্ক না থাকা। মানুষের মহামূল্যবান প্রথাগত জ্ঞানের (Traditional knowledge) সঙ্গে বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের (Scientific knowledge, যেটি আসে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মাধ্যমে) মিলন হয়নি; বরং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষেরা নিজেদের আলাদা শ্রেণিতে অন্তর্ভূক্ত করেছেন। আর প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষদের ‘অশিক্ষিত’ তকমা দেওয়া হয়েছে। একজন সাধারণ কৃষক কৃষিবিদ্যা সম্পর্কে যে জ্ঞান ধারণ করেন, তা অনেক কৃষিবিজ্ঞান পড়ুয়ার মধ্যেও তৈরি হয় না; কারণ তিনি মূলত চেয়ার-টেবিলে বসে কৃষিবিজ্ঞান পড়েছেন এবং এ-বিষয়ের বাস্তব জ্ঞান থেকে বেশ দূরে অবস্থান করেছেন। গ্রামের অনেক সাধারণ কৃষক মেঘ দেখেই বলে দিতে পারেন বৃষ্টি হবে কিনা, সেখানে বড় বড় আবহাওয়াবিদের পূর্বাভাষ ভুল প্রতিপন্ন হয়। বাংলাদেশে তো সেটি প্রায় সময়ই হয়!

একটি প্রশিক্ষণে ড. ফন্দেজ বললেন, তোমরা কি জান রাস্তায় যে শিশুরা বাদাম বিক্রি করে, তারা কীভাবে টাকার হিসেব করে? ওরা তো অনেকে বিদ্যালয়েই যায়নি কোনোদিন। তাহলে হিসেবটা শিখলো কীভাবে? শিক্ষককে আর শিশুকে শেখাবার আগে ওদের কাছে যাও। দেখ, ওরা কীভাবে শিখেছে। ওদের প্রথাগত জ্ঞান কীভাবে অর্জিত হলো, তা শিখে আসো আগে, তারপর তোমার শিশুকে শেখাও। আর তোমার শিক্ষককে শেখাও কীভাবে প্রথাগত জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের শিক্ষা দেওয়া যায়। শিক্ষককে শেখাও যে, জ্ঞান বইয়ে থাকে না, পণ্ডিতের মাথাও থাকে না। থাকে বাস্তব জীবনে, সাধারণ মানুষের মাঝে, মানব সমাজে। তাই শিশুকে শেখানো শুরু করো জ্ঞানের উৎস থেকে। বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে শেখাও। আর যা কিছু শেখাও, তা আবার ওদের বাস্তব জীবনের সাথে যুক্ত করে দাও। ওরা বুঝতে শিখুক, যা শিখছে তা কেন শিখছে। যেটি শেখার দরকার নেই, সেটি ওরা শিখবে না—এ সিদ্ধান্তও ওরা নিতে শিখুক।

এটি একটা দারুণ পাঠ ছিলো। পরে কাজ করতে গিয়ে যখন একটু একটু বুঝতে শিখলাম, তখন দেখলাম, শিশুদের জীবন দক্ষতা আর বাস্তব জ্ঞানের সঙ্গে বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের মেলবন্ধন তৈরি করতে না পারাই হচ্ছে বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় অন্যতম বড় দুর্বলতা। শিশুরা বিদ্যালয়ের বাইরে চারপাশের পরিবেশ থেকে, মা-বাবা বা দাদা-দাদীর কাছ থেকে অথবা অন্য কারও কাছ থেকে এমনি-এমনিই অনেক কিছু শিখে যায়। যেমন হিসেব করা। ওরা হয়তো এখনও সংখ্যাই ভালো করে চেনে না, কিন্তু হিসেব করতে শিখে গেছে। দোকানে ২০ টাকা নিয়ে গেলে খুব ভালোভাবে জিনিসপত্র কিনে টাকার হিসেব করতে পারে। গাছে পাখি বসে থাকে দলে। সেখান থেকে কয়েকটা উড়ে যায়। আর কয়টা এখনও বসে আছে সে হিসেব ওরা ঠিক বের করে ফেলে। ওরা ঠিক জানে ওদের কয়টা জামা আছে। বাড়িতে কয়জন মানুষ আছে। তার মানে যোগ ও বিয়োগের ধারণা তারা বিদ্যালয়ে আসার আগেই পেয়ে যায়। বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা যতো বেশি, হিসেব করার দক্ষতা ততো ভালো। যে ছেলেটি ক্রিকেট খেলা পছন্দ করে, সে রানের হিসেবটাও ভালোই করতে পারে। জেনে যায় কতো হলে সেঞ্চুরি বা হাফ-সেঞ্চুরি হয়। বাস্তব জীবনের এই অভিজ্ঞতাকে কেন আমরা কাজে লাগাই না? কেন আমরা মনে করি, ওরা গুনতে পারে না, তাই গোনা শেখাচ্ছি? যোগ পারে না, তাই যোগ করা শেখাচ্ছি? বিয়োগের ক্ষেত্রেও সেই একই নিয়ম।

আরেকটি অভিজ্ঞতার কথা বলি। একদিন একটি ক্লাসে গিয়ে দেখি, শিক্ষক যোগ অংক শেখাচ্ছেন। একেবারেই অর্থহীন যোগ অংক। ১০-এর সাথে ৮ যোগ করলে কতো হয়। ১০ কোত্থেকে থেকে এলো, আর ৮-এর বাড়ি কোথায় সে কথা কাউকেই বলা হলো না। দেখলাম, কেউ কেউ পারছে; বেশিরভাগই পারছে না। একটু তলিয়ে দেখার কৌতূহল হলো। শিক্ষককে এক কোণায় ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম—যারা পারছে না, তারা কেন পারছে না বলে আপনার মনে হয়? শিক্ষক কিছু মুখস্ত কথা বলে দিলেন। ওরা পড়াশোনায় একেবারেই মনোযোগী নয়, মা-বাবা সচেতন নয়, নিয়মিত বিদ্যালয়ে আসে না ইত্যাদি। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, কিন্তু ঠিক কী কারণে ওরা এই যোগ অংটি করতে পারছে না? তাঁর মাথায় বিশেষ কোনো উত্তর এলো না। কারণ আগে কখনো তিনি এভাবে ভাবেননি। আমি খুব জোরের সাথে বললাম, ওরা সবাই যোগ করতে পারে। যোগ অংক শেখাতে ওদের সেই বাস্তব অভিজ্ঞতাকে কি আমরা কাজে লাগাতে পারি? তিনি নিরুত্তর। এবার তাঁর কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে ক্লাস পরিচালনার ভার আমিই নিলাম। পকেট থেকে ১০, ৫, ২ আর ১ টাকার নোট ও কয়েন বের করলাম। যোগ অংক করতে পারেনি এমন একজনকে টাকাগুলো দিয়ে গুনতে বললাম। মেয়েটি সুন্দর করে গুনে বলে দিল ১৮ টাকা। এরপর আরও কয়েকজনকে দিলাম সংখ্যা পরিবর্তন করে। সবাই পারলো এবং অতি-উৎসাহের সাথে করে দেখালো। শিক্ষককে এবার বললাম, আপনি কি এখনও বলবেন, ওরা যোগ করতে পারে না?

 Course on How Children Learn

আরেকটি ক্লাসের চিত্র। বিয়োগ অংক শেখানো চলছে। চিত্র সেই একই। অভিযোগ, ওরা পারে না। আমি এতো চেষ্টা করি, তাও পারে না। আমি আবার জোরের সাথে বললাম, ওরা অবশ্যই বিয়োগ করতে পারে। আবার দায়িত্ব নিলাম ক্লাস পরিচালনার। শিক্ষক দিয়েছিলেন ১৭ থেকে ৫ বিয়োগ করতে। ভাবছিলাম, বাস্তব উপকরণ কী ব্যবহার করা যায়! ক্লাসে বল ছিলো অনেকগুলো। ১৭টি বল গুনে আলাদা করলাম। এবার একজনকে ডেকে বলগুলো গুনতে বললাম। ও ঠিক গুনে বলে দিলো—১৭টি। এবার বললাম, এখান থেকে ৫টি বল আমাকে দিয়ে দাও। ও গুনে গুনে ৫টি বল দিয়ে দিলো। এবার আবার ওকে বাকি বলগুলো গুনতে দিলাম। ও ঠিক বের করে ফেলল—১২টি বল। এবার বললাম, তাহলে ১৭টি বল থেকে ৫টি বল কাউকে দিয়ে দিলে কয়টি বল থাকে? সবাই বুঝতে পারলো। পারলো, কারণ তারা তো এটা পারেই। সেই পারাটাকেই আমি কাজে লাগাতে চাইলাম। তারপর শিক্ষকের দিকে তাকালাম। তিনি বললেন, এভাবে করলে তো পারবেই! আমি বললাম, এভাবে করতে কেউ তো মানা করে নি আমাদের?

এ লেখার উদ্দেশ্য শিক্ষকের ভুল ধরা নয়। ভুল আমরা সবাই করি। ভুল করা দোষের নয়। ভুল থেকে শিক্ষা না নেওয়াটা দোষের। আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা তুলে ধরলাম বিষয়টিকে সহজ করে উপস্থাপনের জন্যে। এও দেখেছি, অনেক শিক্ষক চমৎকারভাবে শিশুদের পড়াচ্ছেন। অনেকের হয়তো পদ্ধতিগত বিশেষ জ্ঞান নেই, কিন্তু ঠিক নিজের মতো একটি উপায় করে নিয়েছেন। সেটিই বেশি দরকার। যারা প্রশিক্ষণ থেকে শিখে এসেই প্রশিক্ষকের শেখানোর মতো করে ক্লাসে করতে যান, তারা সব মাটি করেন। নিজে আত্মস্থ না করলে কখনোই নিজের মতো করে করা সম্ভব নয়। আর সেটি না করতে পারলে ওই অংক শেখানোর গল্পই চলতে থাকবে সবখানে।

আমরা যারা শিক্ষা নিয়ে কাজ করি, প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করি; তারা কেনো কুরিয়ার সার্ভিসের ভূমিকায় চলে যাই না? শিক্ষকের যেটি ভালো দেখবো, সেটি তুলে নিয়ে সারাদেশে চালান করে দেবো। নিজে সব জানি আর সেটিই শিক্ষককে শেখাবো; এ-মানসিকতা শিক্ষককে শিখতে সহায়তা করে না বরং শ্রেণিভেদ তৈরি করে। আর শিক্ষক আগে যাও পারতেন, প্রশিক্ষণের পরে একেবারে পঙ্গু হয়ে যান। না পারেন নিজেরটি করতে, না পারেন প্রশিক্ষকেরটি অনুসরণ করতে। শেখানোর সঠিক পদ্ধতি অনুসরণে শিক্ষককে উৎসাহিত করার আগে নিজে জানতে হবে সেটি শিশুদের সাথে কীভাবে কাজ করে। সেই বাস্তব জ্ঞান, মুখস্ত কথা নয়।

মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে লক্ষ-কোটি টাকা ব্যয় করা হচ্ছে। কাজের কাজ কী হচ্ছে, তা আমরা সবাই দেখতে পাচ্ছি। মান নিশ্চিত করতে গেলে অনেক কিছু লাগে। সন্দেহ নেই, অনেক কিছু টাকা দিয়ে কিনতে হয়। কিন্তু যেটি আমার চারপাশে পড়ে আছে, যেটি বিনে পয়সায় পাওয়া যায়, সেটির খবর আমরা কয়জন রাখি? তাই শুধু বইয়ে মুখ গুঁজে পড়ে না থেকে আসতে হবে মাটির কাছে। আসতে হবে মানুষের কাছে, জীবনের কাছে যেখানে জ্ঞানের বাস।

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ফ্রেমে আমরা এমনভাবে বন্দি হয়ে গেছি যে, একটু চোখ মেলে তাকাতেও ভুলে গেছি। দেখার দৃষ্টিই হারিয়ে ফেলছি। নিজের ভেতরে তাকাতেও ভুলে যাচ্ছি; নিজের সাথে কথা বলা তো সুদূর পরাহত। আর নিজে না বললে শিশুকে কী করে শেখাবো? ওরা কী করে জানবে, বইয়ের বাইরেও অনেককিছু পড়ার আছে, দেখার আছে? টেলিভিশনে নদী দেখে তার ছবি আঁকা নয়, ওদের নিয়ে যেতে হবে নদীর কাছে। তারপর ও নিজেই ঠিক করুক, নদীর ছবি আঁকবে, নাকি সাঁতার কাটবে; নাকি অন্যকিছু। শুধু বই পড়ে নয়, এই নদী-পাহাড়-সাগর আর সাধারণ মানুষের জীবন দেখেই রবীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথ হয়েছেন।

সাধারণ মানুষের অসাধারণ চিন্তা, চেতনা আর অভিজ্ঞতা ফিরে আসুক আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায়। বন্ধ হোক অন্ধ অনুকরণ। বাইরের স্রোতের সাথে পলিমাটি যেমন এসেছে, তেমনি এসেছে শ্যাওলা ও কচুরিপানা। বাইরের ভালোটা নেই আর খারাপটা ছুঁড়ে ফেলে দিই। আর যে মহামূল্যবান পুরাতনকে বেদরকারি ভেবে অবজ্ঞায় ফেলে দিয়েছি, তাকে আবার কুড়িয়ে নিই। ফিরিয়ে আনি জীবন থেকে শেখার শিক্ষা—যে শিক্ষা মানুষ তৈরি করবে, তোতাপাখি নয়; যে শিক্ষা দেখার দৃষ্টি দেবে, চোখে ঠুলি পরার নয়। মানুষের মধ্যে যে পূর্ণত্ব আগে থেকেই বিদ্যমান, তার বিকাশই হোক শিক্ষার উদ্দেশ্য।

সুদেব কুমার বিশ্বাস: উন্নয়ন-কর্মী, বর্তমানে কর্মরত রয়েছেন জাতিসঙ্ঘ শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার-এ সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা হিসেবে।

0 Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *