fbpx
Teachers Time - 8 6

ছোটবেলা থেকেই আমাদের সমাজে শিক্ষকের মর্যাদা নিয়ে শিক্ষা দেয়া হয়। শিক্ষকের সম্মান পিতা মাতার সমতুল্যই ধরে নেয়া হয়। ধর্মীয় ও সামাজিক ভাবে শিক্ষকের সম্মান এবং মর্যাদার বিষয়ে যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। কাজী কাদের নেওয়াজের “শিক্ষাগুরুর মর্যাদা” কবিতাটিতে শিক্ষকের মর্যাদার উপর আলোকপাত করতে গিয়ে কবি দিল্লির বাদশাহ্ এবং তার পুত্রের উদাহরণ এনেছেন। বাদশাহর পুত্র তার গুরুর পা ধুয়ে দেয়ার জন্য পানি ঢেলে দিচ্ছিল, আর গুরু নিজ হাতে তার পা ধুচ্ছিলেন। এই ঘটনা বাদশাহ দেখে গুরু কে দরবারে ডেকে পাঠান। গুরু মনে করেছিলেন বাদশাহ বুঝি তার রাজপুত্রকে দিয়ে কাজ করানোর জন্য নাখোশ হয়েছেন। কিন্তু পরবর্তীতে বাদশাহ বলেন তার ছেলে কেনো শুধু পানি ঢেলে দিচ্ছিল, কেন নিজ হাতে গুরুর পা ধুইয়ে দেয়নি। গুরুর সম্মান সবার উপরে, আর তা রাজপুত্র বা বাদশাহর চেয়েও বেশি। এই কথা শুনে গুরুর মন খুশিতে ভরে উঠে। আপনাদের জন্য পুরো কবিতাটি এই লেখার শেষে দিয়ে দেয়া হল।

এখন কথা হচ্ছে, শিক্ষক সম্মানের পাত্র এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু তাই বলে কি যে কেউ শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত হলেই এই সর্বোচ্চ সম্মানের যোগ্য হয়ে যায়? আমরা যদি ছাত্রছাত্রীদের খেয়াল করে দেখি, সব শিক্ষকই তাদের কাছে সমান সম্মান পান না। এর কারণ খুজে নিজেদের যোগ্যতাকে উন্নত করতে পারলেই তবে একজন ভাল শিক্ষক হওয়া সম্ভব এবং সকলের সম্মান পাওয়া সম্ভব। 

এই লেখাটি সর্বস্তরের শিক্ষকের জন্যই প্রযোজ্য। তা সে প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক হোক কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। সব শিক্ষকেরই কিছু সাধারণ গুনাবলী থাকা প্রয়োজন যা কিনা তাদের কে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য ও সম্মানিত করে তোলে। আজকের লেখায় আমি ৫ টি বিষয়ের উপর আলোকপাত করবো। অন্য লেখায় প্রতিটি বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করার সুযোগ থাকবে সামনে।

১/ একজন ভালো মানুষ হওয়াঃ

একজন ভালো শিক্ষক হতে হলে প্রথমেই একজন ভালো মানুষ হতে হবে। একজন ভালো মানুষের যে গুণাবলী গুলো থাকা প্রয়োজন তার মাঝে সবার প্রথমেই আসে সততা, সময়ানুবর্তিতা, দয়াশীল এবং ক্ষমাশীল হওয়া। যে কোন শিক্ষার্থীকে নিরেপেক্ষভাবে বিচার করতে সততার বিকল্প নেই। শিক্ষার্থীদের মাঝে ভুল করার প্রবণতা থাকবে, সবসময় তাদের সাথে কঠোর আচরণ করলে ভাল ফলাফল আসবে না। একজন শিক্ষক শুধুই বিষয় ভিত্তিক শিক্ষক এভাবে ভাবলে ভুল হবে। প্রতিটি শিক্ষক তার ছাত্রছাত্রীদের মাঝে অনুসরণীয় মানুষ হিসেবে চিহ্নিত হবেন এটাই কাম্য। তাই শুধু বিষয় ভিত্তিক ভাল জ্ঞান থাকলেই যে কেউ ভাল শিক্ষক হয়ে যায় না। সম্মানিত ও ভাল শিক্ষক হতে হলে অবশ্যই ভাল মানুষ হতে হবে যাকে সকলেই অনুসরণ করবে।

২/ নিজের পড়ানোর বিষয়ে দক্ষতা থাকাঃ

বিষয় ভিত্তিক জ্ঞান অবশ্যই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যেই স্তরেই শিক্ষকতা করাই না কেন, যে বিষয়টি আমি শ্রেণীকক্ষে পড়াবো সে বিষয়ে অবশ্যই আমাদের ভালো জ্ঞান থাকতে হবে। শিক্ষার্থীরা আমাদের কাছ থেকেই শিখে তা তাদের ব্যবহারিক জীবনে কাজে লাগাবে। তা সেটা গণিত, বিজ্ঞান, বাংলা কিংবা ধর্মশিক্ষাই হোক না কেন। নিজ নিজ বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করেই তবে পড়ানো উচিত। এক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত পড়ালেখা করাটাও একজন ভাল শিক্ষকের গুণাবলীতে পরে। কোন একটি ডিগ্রি অর্জন বা সার্টিফিকেট অর্জনের সাথে সাথে সব যোগ্যতা বা দক্ষতা চলে আসে না। এর জন্য প্রতিনিয়ত চেষ্টা এবং জ্ঞান অর্জন করে যেতে হবে। আধুনিক এই বিশ্বে যে কোন বিষয়ে জ্ঞান অর্জন অনেক সহজ হয়ে গিয়েছে। বইয়ের পাশাপাশি ইন্টারনেটের সাহায্য নিয়ে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন জিনিস শেখা যায়। ক্লাসে যাওয়ার আগে ক্লাসে পড়ানোর বিষয়টিতে প্রস্তুতি নিয়ে যাওয়া একজন ভাল শিক্ষকের অভ্যাস। এতে করে ক্লাস হয়ে উঠে প্রাণবন্ত। একজন শিক্ষক যখন আত্মবিশ্বাসী থাকে তখন শিক্ষার্থীরাও তার কাছ থেকে শিখতে আগ্রহী হয়।

৩/ আধুনিক শিক্ষা সরঞ্জামের সাথে পরিচিত থাকাঃ

শিক্ষকতা পেশার সাথে জড়িত অনেকেই সময়ের সাথে সাথে তাদের শিক্ষা উপকরণ পরিবর্তনে মনোযোগী থাকেন না। কিন্তু বর্তমানে প্রতিনিয়ত প্রযুক্তি পরিবর্তন হচ্ছে, আমাদের দৈনন্দিন জীবনে যুক্ত হচ্ছে নানা নতুন উপকরন। তেমনি পড়ানোর ক্ষেত্রেও শিক্ষা সরঞ্জামের যুগোপযোগী ব্যবহার করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের মনযোগ ধরে রাখার জন্য দশ বা বিশ বছর আগের কোন উদাহরণ দিলে কাজ করবে না। যে কোন বিষয়কে বর্তমান, কোন কোন ক্ষেত্রে ভবিষ্যতের উদাহরণ দিয়ে বুঝাতে হবে। এজন্য প্রত্যেক শিক্ষক কে নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে। আপনি যে বিষয়ের শিক্ষকই হোন না কেন, যে স্তরের শিক্ষকই হোন না কেন, কম্পিউটার, ইন্টারনেট ব্যবহার এবং বর্তমান বিশ্বের নিত্যনতুন সব ব্যাপারে আপনার জ্ঞান থাকতে হবে। সাথে যে কোন পড়ার অংশের সাথে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের উপকরণ বা ঘটনার সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে উদাহরণ দিতে হবে যেন ছাত্রছাত্রীরা সহজেই বুঝতে পারে। এমন কিছু উদাহরণ দিয়ে লাভ হবে না যা ছাত্ররা কখনই দেখে নি বা শুনে নি।

৪/ অনুপ্রাণিত করার ক্ষমতা থাকাঃ

একজন ভাল শিক্ষক হওয়া আসলে সহজ কাজ নয়। মৌলিক বিষয় গুলোতে দক্ষ হওয়ার পাশাপাশি আসলে অন্য সাধারণ মানুষ এর চেয়ে একটু ভিন্নকিছু বৈশিষ্ট্য শিক্ষকদের মাঝে থাকা চাই যা দেখে ছাত্রছাত্রীরা তাকে অনুসরণ করবে। সেটা হতে পারে তার বাচনভংগি, পোশাক, ভাল ব্যবহার। একজন শিক্ষক যখন তার ছাত্রছাত্রীদের কাছে অনুসরনীয় ব্যাক্তিত্ব হিসেবে চিহ্নিত হবে তখন তাদের শেখার ইচ্ছাটাও আরও বেড়ে যাবে। শিক্ষকদের কাজ শুধুই পড়ানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, সাথে শিক্ষার্থীদের অনুপ্রানিত করাও। যেন তারা নিজে থেকে শেখার দক্ষতা তৈরি করতে পারে।

৫/ প্রত্যুৎপন্নমতি হওয়াঃ 

সব শেষে আজকে যে বিষয়টি আলোচনা করবো তা হচ্ছে  “প্রত্যুতপন্নমতি” হওয়া বা উপস্থিত বুদ্ধির অধিকারী হওয়া। একজন শিক্ষকের জন্য যা খুবই জরুরী। শিক্ষার্থীরা ক্লাসে যেকোন বিষয়ে নানা রকম প্রশ্ন করতে পারে। এজন্য শিক্ষককে সব সময় প্রস্তুত থাকতে হবে। প্রশ্ন করতে দেয়াও একজন ভাল শিক্ষকের গুণ। তাই ছাত্ররা প্রশ্ন করলে তাকে নিরুৎসাহিত না করে বরং উৎসাহিত করা এবং তার প্রশ্নের উত্তর দেয়া উচিত। এমন হতেই পারে যে শিক্ষক সরাসরি উত্তর জানেন না বা বিব্রতকর কোন প্রশ্ন। সেক্ষেত্রে একটু ঘুরিয়ে সুন্দর ভাবে উত্তর দেয়া জানতে হবে। এই বৈশিষ্ট্য রপ্ত করতে পারলে একজন শিক্ষক জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারেন।

শিক্ষক ভালো না খারাপ এটা বিচার করা খুবই কঠিন কাজ। তাই আপনি একজন ভালো শিক্ষক কি না তা আপনি নিজেই ঠিক করবেন। নিজেকে নিজে বিচার করে নিজের যোগ্যতাকে উন্নত করার মধ্যেই আসলে ভালো শিক্ষক হয়ে ওঠা যায়। শেখার কোন সীমা নেই। তাই একজন শিক্ষক যে সব জানবেন তা ভেবে আত্মতৃপ্ত হওয়ার সুযোগ নেই। আমরা ভালো শিক্ষক এবং ভালো মানুষ হয়ে উঠতে পারলেই আমাদের ছাত্রছাত্রীরা জ্ঞানী এবং ভাল মানুষ হিসেবে গড়ে উঠবে।

শিক্ষাগুরুর মর্যাদা — কাজী কাদের নেওয়াজ

বাদশাহ আলমগীর-
কুমারে তাঁহার পড়াইত এক মৌলভী দিল্লীর।
একদা প্রভাতে গিয়া
দেখেন বাদশাহ- শাহজাদা এক পাত্র হস্তে নিয়া
ঢালিতেছে বারি গুরুর চরণে
পুলকিত হৃদে আনত-নয়নে,
শিক্ষক শুধু নিজ হাত দিয়া নিজেরি পায়ের ধুলি
ধুয়ে মুছে সব করিছেন সাফ্ সঞ্চারি অঙ্গুলি।
শিক্ষক মৌলভী
ভাবিলেন আজি নিস্তার নাহি, যায় বুঝি তার সবি।
দিল্লীপতির পুত্রের করে
লইয়াছে পানি চরণের পরে,
স্পর্ধার কাজ হেন অপরাধ কে করেছে কোন্ কালে!
ভাবিতে ভাবিতে চিন্তার রেখা দেখা দিল তার ভালে।
হঠাৎ কি ভাবি উঠি
কহিলেন, আমি ভয় করি না’ক, যায় যাবে শির টুটি,
শিক্ষক আমি শ্রেষ্ঠ সবার
দিল্লীর পতি সে তো কোন্ ছার,
ভয় করি না’ক, ধারি না’ক ধার, মনে আছে মোর বল,
বাদশাহ্ শুধালে শাস্ত্রের কথা শুনাব অনর্গল।
যায় যাবে প্রাণ তাহে,
প্রাণের চেয়েও মান বড়, আমি বোঝাব শাহানশাহে।

তার পরদিন প্রাতে
বাদশাহর দূত শিক্ষকে ডেকে নিয়ে গেল কেল্লাতে।
খাস কামরাতে যবে
শিক্ষকে ডাকি বাদশা কহেন, ”শুনুন জনাব তবে,
পুত্র আমার আপনার কাছে সৌজন্য কি কিছু শিখিয়াছে?
বরং শিখেছে বেয়াদবি আর গুরুজনে অবহেলা,
নহিলে সেদিন দেখিলাম যাহা স্বয়ং সকাল বেলা”
শিক্ষক কন-”জাহপানা, আমি বুঝিতে পারিনি হায়,
কি কথা বলিতে আজিকে আমায় ডেকেছেন নিরালায়?”
বাদশাহ্ কহেন, ”সেদিন প্রভাতে দেখিলাম আমি দাঁড়ায়ে তফাতে
নিজ হাতে যবে চরণ আপনি করেন প্রক্ষালন,
পুত্র আমার জল ঢালি শুধু ভিজাইছে ও চরণ।
নিজ হাতখানি আপনার পায়ে বুলাইয়া সযতনে
ধুয়ে দিল না’ক কেন সে চরণ, স্মরি ব্যথা পাই মনে।”

উচ্ছ্বাস ভরে শিক্ষকে আজি দাঁড়ায়ে সগৌরবে
কুর্ণিশ করি বাদশাহে তবে কহেন উচ্চরবে-
”আজ হতে চির-উন্নত হল শিক্ষাগুরুর শির,
সত্যই তুমি মহান উদার বাদশাহ্ আলমগীর।”

শিক্ষকদের জন্য Teachers Time শুরু করেছে বেশ কিছু Recorded Course, যা থেকে উপকৃত হচ্ছেন অগণিত শিক্ষক । আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যৎ যাদের হাতে সেই শিক্ষাগুরুদের জন্য রইল শুভকামনা সবসময় ।

0 Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *